Bangladeshi Marine Community, Singapore

Bangladeshi Marine Community, Singapore

প্রিয়তমেষু নীল : সাদিয়া রহমান #3

অনেকদিন ধরেই লিখবো লিখবো করে লেখার কোন সুযোগ হয়ে ওঠেনি। আমার অতি প্রিয় ও আপনজন রুবা ভাবীর অনুপ্রেরনায় আজ লিখতে বসলাম। রুবা ভাবীকে আমার অন্তরস্থল থেকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি শুরু করছি।

ভালোবাসার অনেক রং থাকে আর তা দু চোখ মেলে দেখার সৌভাগ্য সবার হয় কিনা তা আমার জানা নেই। যেই চোখেই দেখি না কেন সে রং ভালবাসার চখ দিয়েই দেখতে হয়। আমার ভালোবাসার রং “নীল”। ‘প্রিয়তম এবং নীল’ এই দুটি শব্দ যেন আমার জীবনের স্রোতধারার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।

দক্ষিনাঞ্চলের কুয়াকাটার নিকটস্থ সাগর কন্যা খ্যাত পটুয়াখালী। সেখানেই আমার জন্ম। আর বড় অ হয়েছি তার ধুলো বালি গায়ে মেখে। কুয়াকাটা সমুদ্রতীরে কতবার গিয়েছি তার হিসেব নেই। কিন্ত যতবারই যেতাম প্রতিবারই আমি নতুন করে সমুদ্রকে উপলব্ধি করতাম। তার শীতল বাতাসে আমার চুল ওড়ার শব্দ শুনতে পেতাম। আমার হৃদয় প্রসন্ন হতো তার তীরে আছড়ে পরা সুর লহরীতে।

সাগর কন্ন্যা আমাকে হাতছানি দিয়ে শুধু ডাকতো, আবার কবে দেখা হবে? ওর নোনা জলের  স্পর্শ আমার সব দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দিত। আমি ওর প্রেমের আকুতি শুনতে পেতাম।

সাগরের এই ভালবাসা যেন গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকল। তারপর একদিন পড়ন্ত বিকেলে তার সাথে দেখা হল, সেই আমার সাগর, আমার প্রেম। সে পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। জাহাজে চাকরি করেন। ধুম ধাম করে তার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। কয়েকটি দিন যেন আজানা এক ঘোরের মাঝে কেটে গেল। তারপর কোন এক বিদায় দেবার বেলায় তার হাত দুটো ধরে অনেক কাঁদলাম। আমার প্রিয় সমুদ্রের ডাকে আমারই প্রিয় চলে গেল আমায় একা ফেলে। নতুন করে নিজেকে আবিস্কার করলাম, আমি একা বড়ই একা। এরপর সে আনেক বার ফিরে এসেছে, আবার তাকে অস্রুজলে বিদায় জানাতে হয়েছে। প্রায়ই বলতাম “আমাকে ও তোমার সাথে নিয়ে চলো”। তারপর এক দিন ফাহিম এলো আমাদের ঘর আলো করে। আমার একাকী জীবনে কিছুটা খুজে পাওয়া সস্তি। প্রতিবার যখন অ জাহাজে চলে জেত, আমি আমার ছেলে কে বুকে ধরে তার কষ্ট ভুলেছি।

একদিন সকালে ওর ফোন পেয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। আমি আমার প্রিয়তমেসুর কাছে যাচ্ছি। আমি জাহাজে যাচ্ছি। মনে হচ্ছিল আমার প্রিয়তম এবং বিশাল নীল সাগর যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করে আছে। আমি আমার এক বছরের ছেলে ফাহিমকে নিয়ে জাহাজে ওঠার সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করলাম। ক্রমশই দিন টি ঘনিয়ে এলো আর আনন্দে মন নেচে উথল।
ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে করে গিয়ে পৌছাঁলাম স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ। জীবনে এই প্রথম বিদেশ পাড়ি দিলাম। মাদ্রিদ এয়ারপোর্টে প্রায় সাড়ে এগার ঘন্টা ট্রানজিট শেষে আবার আর একটি উড়োজাহাজ করে পৌছাঁলাম স্পেনের আর একটি অংঙ্গ রাজ্য ভিগো। ভিগো পৌছেঁ জানতে পারলাম জাহাজ তখনও পোর্টে পৌছায়নি। সেখানকার স্থানীয় এজেন্টের লোক এসে আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি একটি হোটেলে রেখে আসলেন। সন্ধ্যায় আবার এজেন্টের লোক এসে আমাদের হোটেল থেকে নিয়ে জাহাজ পৌছেঁ দিলেন। সাত সমুদ্র তের নদী পার হওয়ার গল্প ছোট বেলায় অনেক শুনেছি। কিন্ত সেদিন আমি নিজেই সাত সমুদ্র তের নদী পার হওয়ার মানে বুঝতে পেরেছিলাম। যাই হোক, এত বড় লম্বা সফর করে অবশেষে আমি আমার প্রান প্রিয় মানুষটির কাছে পৌছাঁতে সক্ষম হয়েছিলাম।সমুদ্রের বুকে যখন জাহাজ ভেসে চলত, আমার কাছে মনে হতো উত্তাল সমুদ্রের মাঝে ছোট একটি সাম্পানে করে আমরা ভেসে যাচ্ছি। আর আমার ছেলে হাঁটা শিখেছিল জাহাজের ঢেউয়ের তালে তালে। আমরা সেখানে সাত মাসেরও বেশী সময় ছিলাম। নিজেকে যখন একাকী মনে হতো বিশাল সমুদ্রের দিকে তাকালেই মনটা ভাল হয়ে যেত।

সেই দিনগুলোর কথা আজও আমার মনে পরে। আমাদের সাথে আমার প্রিয়তমেষু ও দেশে ফিরে আসার কথা ছিল, কোন এক বিশেষ কারনে সে আমাদের সাথে আসতে পারেনি। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমরা দেশে ফিরে এলাম। সেদিন আমি এবং আমার ছেলে খুব কেদেঁছিলাম। প্রিয়জন কে একা ফেলে আসার কারনে আমার কখনও কাদঁতে হয়নি। কিন’, সে আমাকে একা ফেলে চলে যাওয়ার কারনে আমাকে অনেক বার কাদঁতে হয়েছে।

নীল হচ্ছে বেদনার রং, হয়তোবা নিয়তি আমার ভালোবাসর সাথে একটু বেদনা জুড়েই আমার ভালবাসাকে পরিপূর্ণ করেছে।

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *