Bangladeshi Marine Community, Singapore

Bangladeshi Marine Community, Singapore

সাধু ও চলতি ভাবনা

সমীর দাস

সম্পাদক মহাশয় কর্তৃক আদিষ্ট হইয়া গল্প লিখিতে বসিলাম। অনেক আয়োজন করিয়া, গৃহদ্বারে  খিলান দিয়া, জানালার পর্দাকে সমূলে উৎপাটন করিলাম, যাহাতে আকাশের দিকে তাকাইতে বিঘ্ন না ঘটে। শুনিয়াছি শূণ্যে তাকাইয়া গভীরভাবে ভাবিলেই ফল্গুধারার ন্যায় লেখা আসিতে থাকে। গল্প নাকি কোনো ব্যাপার না। একটা প্রধান চরিত্র আর তাহাকে আবর্তন করিয়া কিছু উপচরিত্র, সাথে নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরী করিয়া, মনের মাধুরী মিশাইয়া ঘুটা দিলেই গল্প হইয়া যায়। আহা, কত সহজ !  অন্তর্জালের একজন লেখক আমাকে গল্প লেখার গোপন কলাকৌশল এইভাবেই শিখাইয়া দিলেন। সর্বশেষে, কিরিটিরায়ের মতন ফিসফিস করিয়া পুরানো একটি বাণীও শুনাইয়া দিলেন, ‘গল্পটি এমন হইতে হইবে যাহাতে মনে হইবে শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। ঠিক করিয়াছি, একবার আসিয়া পড়িলে কোনোভাবেই উহাকে শেষ করিতে দিবো না। সবই বুঝিলাম, কিন্তু কিছুতেই কিছু হইলো না, ধূমায়িত চা হিমায়িত হইল, কলমের নিষ্পেষণে কাগজ ছিঁড়িল বটে, উনি বাহির হইলেন না।  

ভাবনা যখন আশাহত তখন দরজায় টোকা পড়িল, কিঞ্চিৎ খোলা দরজায় বছর ন’য়ের শুদ্ধ উঁকি দিলো। মনে হয় উহার মনে নতুন কোনো প্রশ্ন জাগিয়াছে।  ইদানিং লক্ষ্য করিয়াছি, ছোটদের সৎ ও সহজ  প্রশ্নের জবাব দেওয়া বড়ই কঠিন । শুদ্ধর হাতে একখানা ছবি, কিছু একটা আঁকিতেছে, মনে হইল পরিবার। ইদানিং এই ব্যাপারে অনেক কথাবার্তা হইতেছে, লোকজন অনেক  সচেতন,  মানসম্পন্ন সময় কাটানোর জন্য বড়সড় কর্মযজ্ঞ চলিতেছে। ঘরে-বাইরে, দেশে-বিদেশে দৌড়াদৌড়ি, ক্লিকে-ক্লিকে হাসি, মুখপুস্তকে রঙ্গীন ছবির বন্যা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্মৃতিদের জোড়া লাগাইয়া প্রভুকূলকে মুঠোফোনে ধ্যানস্থ রাখিবার পূর্ণ আয়োজনে ব্যস্ত।  সবই হইতেছে, তাহার পরেও মনে হয় কিছু একটা নাই।  চোখ আকাশ হইতে রাস্তায় নামিল। দূরের জনশূন্য রাস্তায় সোডিয়ামের আলো জ্বলিতেছে। আমি প্রাণ খুঁজিতেছিলাম।

সন্ধ্যা হইয়াছে, মাইকে আজানের ধ্বনি, আশেপাশে ধুপ-ধুনার সুগন্ধ। টিম-টিম করিয়া জ্বলিতেছে এডিসনের  বাতি। আশেপাশের  ছাত্রছাত্রীরা  পড়াশোনায় সুর চড়াইয়াছে। ইহার  মাঝে  হঠাৎ  করিয়া  কারেন্ট  চলিয়া  গেলো। নিয়ত অপেক্ষমান  প্রদীপের শিখা বড়  হইল। বই রাখিয়া সবাই তখন উঠানে। চারিদিকে  মিষ্টি  আলোর  উৎসব, মৃদুমন্দ বাতাস, সুপারি  গাছের ফাঁকে রূপালী চাঁদ। জোনাকির নক্ষত্র-আলো বাগানের মাঝে। মায়াবী এই সময়ে, কে  ঘরে  বসিয়া থাকিবে? উঠানে  বিছানা  পড়িল, পাড়ার  দাদু-দিদা , পিসিমণিরা  আসিল, গল্পের  ঝুম  উঠিল।  সমবেত  হাসিতে মুখরিত হইল চারিধার।  সদাব্যস্ত জননীও হালকা  মুড়ি-মুড়কি লইয়া  আসরে  যোগ  দিলেন।  মনে  হইল  প্রকৃতির সাথে  যেন  রাত্রিও  চুপিচুপি পরিবার সমূহের  গল্পগাঁথা আগ্রহ লইয়া শুনিতেছে।   

হঠাৎ কোথায় যেন হারাইয়া গিয়াছিলাম, গল্পচ্যুত হইয়া যাইতেছি না তো ? এই ভাবে কালক্ষেপন  করা  যাইবে  না। রাস্তায় দোতলা বাস দেখিলাম। পূর্বে ইহারা লাল ছিল, এখন সবুজ।  চারিদিকে এখন সবুজের জয়গান। আমাজন ক্ষুদ্র হইতেছে তাহাতে কি, দেয়ালতো সবুজ আছে।

ঘর ছাড়িলাম। নাতিদূরে খানাপিনার জায়গায় যাইতে হইবে। গল্পের জন্য আর কত ত্যাগ? চায়ের কাপ নিয়া এক কোনায় বসিয়া পড়িলাম। দুই টেবিল পরেই একটি পরিবার রাতের খাবারের জন্য বসিয়াছে। দেখিয়া নয়ন জুড়াইলো। আহা, কি সুন্দর!  ভদ্র, সুশীল, মুঠোফোনে আত্মমগ্ন চারের নিঃশব্দ পরিবারটি ভবিষ্যতের আলোয় ঝকমক করিতেছে। সর্বগ্রাসী একত্বের চাপে বহুত্ব ক্রমাগত চাপা পড়িতেছে। যৌথ পরিবার ভাঙিয়া জীর্ণদের পরিগ্রহ করিতে নিউক্লিয়াস তৈরী হইয়াছে। একসময়ের প্রতাপশালী সাধু এখন ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়তে আসিয়া ঠেকিয়াছে।

বিবর্তনের সহজ ও শর্টকাট ভাবনাকে সরাইবার সাধ্য কার? যখন দেখি প্রোটন শুধু ভারী হইতেছে, আর বাকি সকল কণিকাসমূহ ক্রমাগত দূরে সরিয়া যাইতেছে, তখন মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ নীতির চেয়ে মানবিক দৈন্য বড় বেশি চোখে লাগে। আধুনিকতার কংক্রিটে ঘেরা নচিকেতার জীর্ণাশ্রমের ঠিকানাটা ঠিক কতটা দূরে?

সমীর দাস (২৮):  সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং সমাজ সচেতেনতার প্রতি বিশেষ আগ্রহ আছে। সিঙ্গাপুর প্রবাসী। কাজ করছেন শিপ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে।
Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *