তাহসীনা সাইফুল্লাহ
সেই অর্থে ড্রইংরুম বলতে যা বোঝায় আমাদের বাসার ড্রইংরুম কোন অর্থেই তা নয়। সজ্জা বা বন্দোবস্ত বলতে, স্প্রিঙ ও ফোম দিয়ে বানানো বহু পুরনো একটা থ্রি সিটার ডিভানের মতো আছে। সাদা মার্কিন কাপড় কিনে দরজি দিয়ে বড় ফুপু এগুলোর খোল তৈরী করে নেন। বেশ মজবুত ও যত্নে পরিষ্কার। কিন্তু বহুব্যবহারে সাদা রঙের খোলে এখন মরচে পরা দাগ। এটির সমকোণে এক জোড়া টু সিটার। দুপুর তিনটে পঁচিশ, বুড়ো বুড়ো তিনটে লোক এসেছেন বাড়িতে। পাশেই দু’টো খালি সোফা থাকতেও একসাথে গাদাগাদি করে বসেছেন ঐ তিন সিটারে। কেনো যেনো তাদের বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। আর আমি, সাত বছরের তুতুল একটা টু সিটারে জাঁকিয়ে বসে মন দিয়ে দেখছি তাদের। বিভিন্ন প্যাটার্ন ও রঙের চেক শার্ট আর ঢোলা ঢোলা প্যান্ট পরেছেন প্রত্যেকেই। আজকালকার ফ্যাশনের নয়। ব্যাকডেটেড। আমার জুলজুল করে তাকানো চোখের সামনে উসখুস করছিলেন ওনারা। প্রথমজন আস্তে করে বললেন, তোমার বাবা কই মা? বাবা বড়িতেই আছেন। আমাদের সাকুল্যে তিনটা মাত্র ঘর। তারই একটাতে বিছানায় চুপ করে বসে আছেন। মা’ কিছুক্ষণ আগেই বাবার সাথে খুব রাগ হয়ে হয়ে কথা বলছিলেন। আমার মা, সবসময় রেগে থাকেন। সবকিছুতেই তার খুব রাগ হয়। এই যেমন আজকে বাবা কিন্তু তেমন কিছুই বলেননি, শুধু মা’র কিছুক্ষণ আগে কাপড় দিয়ে যত্নে পরিষ্কার করে যাওয়া জানালার লোহার শিকে সিগারেটের শেষটুকু ঘসে ঘসে নেভাতে নেভাতে জানতে চেয়েছিল, আজ কি দিয়ে ভাত রুনু? মা জ্বলন্ত চোখে একবার বাবার দিকে আরেকবার বাবার হাতে পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটের কড়াটুকুর দিকে তাকিয়ে হঠাৎই চিল চিৎকার শুরু করলেন। সে কি রাগ! সে কি কঠিন কঠিন কথা! পুরনো রঙচটা রূপা গেঞ্জিটার অজস্র ফুটো দিয়ে কথাগুলো যেন বাবার শরীরে ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন মা।
বাবা গুম হয়ে আছেন এরপর থেকেই। আর মা বাসার একচিলতে বারান্দা যা কিনা রাজ্যের ভাঙা বালতি, কাঁচের শিশিবোতল, প্লাস্টিকের জ্যারিকেন আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংসারের নানা জঞ্জাল বুকে নিয়ে পরে থাকে তারই এককোনে ঝিম ধরে বসে আছেন। মেজ’কা নতুন বিয়ে করেছেন। এই দেড়মাস হলো। দু’খানা বেডরুমের যেটাতে বড়ফুপু, মেজফুপু আমায় নিয়ে ঘুমাতেন সেটায় এখন মেজ’কা মিষ্টি কাকিকে নিয়ে থাকেন। আর আমরা তিনজন ড্রইংরুমে। বহুকাল আগে যাকে কার্পেট বললেও বলা যেত এমন একটা রঙচটা মাদুরের মতো জিনিসের ওপর সদ্যকাচা চাদর পেতে আমার ফুপুরা মেঝেতে শোয় আর আমার যেহেতু খুব অসুখ হয়, মাটিতে শুলে বুকে কফ বসে শ্বাসকষ্ট উঠে যাবে তাই আমি একটা কাঁথা বিছিয়ে ঐ থ্রি-সিটারে ঘুমাই। তবে রাত একটু গভীর হলে, যখন সারাদিনের সং নামক সারে’র নানান রঙতামাশা ও কাজকর্ম সামলে হা-ক্লান্ত বড় ফুপুর শ্বাস ভারী হয়ে আসে, আমি আস্তে করে সোফা থেকে পিছলে নেমে চুপিচুপি বড় ফুপুর কোলের মধ্যে ঢুকে যাই।
আমার বাবা এবং কাকা দু’জনই জীবনের জুয়া খেলায় হেরে যাওয়া মানুষ। স্বভাবতই মুখচোরা, কিছুটা স্বার্থপর ও অবিমৃষ্যকারী। আমার বাবা একটা গার্মেন্টসে সুপারভাইজারের চাকরী করতেন। তার আগে একটা কম্পিউটারের দোকানে কম্পোজের কাজ করতেন। তারও আগে যখন তিনি সিটি কলেজের ছাত্র ছিলেন, টিউশনি করতেন। তখনই মাত্র তেইশ বছর বয়সের বাবা সতেরো বছরের মা’কে নিয়ে পালিয়ে দাদুর এই হা-পুরনো তিনরুমের ফ্ল্যাটে এসে উঠেছিলেন। ঐ শুরু। সম্পন্ন ঘরের মেয়ে মা’র প্রেমের ঘোর কাটতে কাটতেই ততদিনে তার পরিচয় তিনি এক কন্যার মা, বাজারের দোকানের একজন সামান্য কম্পিউটার কম্পোজারের স্ত্রী। বৃদ্ধ শ্বশুরের একার সরকারী চাকরীর ওপর নির্ভর সংসার,ঘরে শাশুড়ি নেই ,বেকার বেয়ারা একজন দেবর, দু দু’জন অবিবাহিত ননাস। তাদের একজন আবার প্রকৃতিগতভাবেই স্পেশাল।
আমার মেঝ ফুপু’ কথা একটু জড়িয়ে যায়, স্বাভাবিকের চেয়ে ভারী শরীর, চাপা রঙ আর একমুখ সরল হাসিতে মাখামাখি সে। যদিও আমার কাছে তাঁকে খুব মিষ্টি লাগে কিন্তু উনাকে নিয়ে আমার পরিবারের সকলের চাপা অনেক কষ্ট। দাদুর মুখে কখোনো কখোনো অস্ফুটে ‘অভিশাপ’ শব্দটাও কানে আসতো। কেন যে মেঝো ফুপুকে দাদু অভিশাপ মনে করতেন সেটা আমার মাথাতেই আসেনা! শিশুর মতো সরল আর আনাড়ি মেঝ ফুপু কিন্তু দাদুর সবচেয়ে বেশি ন্যাওটা ছিলেন। যেদিন হতাশ ক্লান্ত জীবনযুদ্ধে পরাস্ত মানুষটা শেষবারের মতো অফিস থেকে ফেরেন, আমার বয়স তখন ছয় । সন্ধ্যে সন্ধ্যে দাদুর সেদিন খুব বুকে ব্যাথা হলো, বড় ফুপু তখোনো পাড়া’র টানা টিউশনি থেকে ফেরেননি। মা’র সুন্দর মুখটা দাদুর প্রবল ব্যাথা দেখে ভয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে। মেঝ ফুপু একটা ছোট কাঁচের বাটিতে সর্ষের তেল গরম করে দাদুর বুকে মালিশ করতে এসে সবটুকু তেল বুকের ওপর ফেলে দিয়েছিলেন। দাদুর কালো শরীরটা যখন পরদিন গোসল করিয়ে তৈরী করা হয় তখনও বুকটার কাছে পোড়া জায়গাটা দগদগ করছিল। বড় ফুপু পাথর মুখে দাদুর পায়ে হাত দিয়ে চুপ করে বসেছিলেন, বাবা ও কাকা রাঙা চোখে অযথা ব্যস্ততায় ছোটাছুটি করছিলেন আর মেঝো ফুপি ও মা আকুল হয়ে কাঁদছিলেন। একটা ভঙ্গুর পরিবার একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটার বিদায়ে আরো ভঙ্গুরতম হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বা পিতৃবিয়োগের বেদনায়।
আমার বড় ফুপু সারাদিন ঘরের সব কাজ করেন। পুরনো রঙচটা আসবাবগুলো ঝাড়ামোছা, চকচকে করে রাখা, রান্না সব সব। মেঝ ফুপু পাশে পাশেই থাকেন ছায়ার মতো। কিছুদিন হলো মেঝো কাকিও টুকটাক হাতে হাতে এটা সেটা এগিয়ে সাহায্য করেন। শুধু মা কোন কাজ করেন না। দিনরাত ঘরের মধ্যে বন্দী থেকে কি যে করেন! হয়তো তার নিজের জন্য তার বড় দুঃখ। আমার মনে হয় মা এমনকি আমাকেও তেমন ভালোবাসেন না। আমার জন্য তার কোন নেই আকড়া নেই, ভাব ভালোবাসার প্রকাশ নেই। আমি তাই পোষা বেড়ালের মতো আমার ফুপুদের আশে পাশেই ঘুরঘুর করি সবসময়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই বড় ফুপু আমাদের পাড়ার প্রায় আট দশটা বাচ্চাকে অংক ও বিজ্ঞান পড়ান। টানা তিন চার ঘন্টা। এই একটা মাত্র নিয়মিত রোজগারই এখন আমাদের পরিবারের অন্নসংস্থানের মূল রসদ যোগায়। অকর্মণ্য, কুঁড়ে হলে কি হবে প্রবল আত্মসম্মান আমার বাবা, কাকা’র। তারা আবার কাজের খোঁজে কারো কাছে যাবেন না। এই যে বাবার গার্মেন্টস এর চাকরীটা চলে গেছে কারখানার মন্দা’র জন্য, আরেকটা চাকরী খোঁজার নামমাত্র চেষ্টা বা উদ্যোগ তার নেই। তাই হয়তো মাঝে মাঝে মা অমন ক্ষেপে যান। আমাদের কালোকুলোদের পরিবারে অমন সুন্দর মা’ কি অসুন্দরের মতন কুরুক্ষেত্র যে বাঁধান তখন।
আমার কাকা মাধ্যমিকটাও শেষ করেননি। দিদুন চলে যাওয়ার পর এই ছেলেটা যে কবে কখন একটু একটু অবহেলায় পুরো বখে গিয়েছিলো তা কেউ টের পায়নি। কোল পোঁছা ছেলে বলে বড় আদরের ছিল নাকি কাকা দিদুনের। দিদুনের অবর্তমানে সংসারের শতেক দিক সামলে দাদু বা বড় ফুপুও বুঝতে পারেননি অনেকদিন, আদুরে ছেলেটার বুকে বড় অভিমান জমা হচ্ছে, সে পড়ছেনা, খাচ্ছেনা, কলেজ ঠিকমতো যাচ্ছে না। একদিন যখন তার বোর্ড পরীক্ষা চলে আসলো পাস করতে মরিয়া এই ছেলে নকল করার ব্যর্থ চেষ্টায় মান সম্মান ধূলায় লুটিয়ে এক্সপেল হয়ে বাড়ি ফিরেছিল। বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল পরিবারটার প্রত্যেকটা মানুষ। সেই শুরু। এরপরের গল্পটা শুধুই হেরে যাবার আর লুকিয়ে পরার। কাকা যেন তারপর থেকে এক ছায়ামানব হয়ে মিশেছিলেন এ সংসারে। তিনি আছেন আবার নেইও। সেই ছেলেই হঠাৎ আরেকবার প্রবল আন্দোলন তুললেন আমাদের সরল পরিবারটার নিস্পন্দ জলের বুকে। এক প্রায় বস্তির মেয়ে বিয়ে করে এনে!
তারপরও কেউ কিচ্ছু বলেনি কাকা’কে সেদিন। শুধু বাবা একটু তেড়েফুঁড়ে উঠতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মা এমন করে তাকিয়েছিলেন বাবা’র দিকে যে বাবা চুপ করে ফণা নামিয়ে ঘরে চলে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বেডরুমটা থেকে বড় ফুপু তখন নিরবে কিন্তু দ্রুত হাত চালিয়ে তার আর মেঝ ফুপুর জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। আর মেঝ ফুপু কিছু বুঝতে না পেরে বারবার বলছিলেন ‘আপা, আমাদের জিনিস কেনো সরাচ্ছিস আপা? আমরা কোথায় যাবো? ও আপা , আপা?’ জিনিস আর কটাইবা । সব নিয়ে বের হয়ে বিছানায় একটা পরিষ্কার চাদর টানটান করে বিছিয়ে ড্রইংরুমের সোফায় মাথা নিচু করে বসে থাকা নবদম্পতির কাছে এসে আস্তে করে বলেছিলো, যাও ছোট বৌ, ঘরে যাও। কাকি প্রায় কিশোরী একটা মেয়ে, সে ভয়ে এতটুকু হয়েছিলেন। না জানি আজ কি আছে কপালে! বেকার, উড়নচন্ডী বর হলে কি হবে, ভদ্রলোকের ছেলে, শিক্ষিত রুচিশীল পরিবার। পাড়াতে সবাই এদের ভালো বলে, আর সে ?পাশের ঝুপড়ি রিকশা গ্যারেজের মালিকের মেয়ে। কিন্তু না, সেদিন কোন অসুন্দর হয়নি কোথাও। মা, বড় ফুপু হতে দেননি। তাই বড় ফুপুর পাশেপাশে দিনভর মিউ বিড়ালের মতো শুধু আমিই ঘুরঘুর করিনা, কাকিও করেন।
দেখুন! আজ দুপুরের গল্প বলতে গিয়ে কত কি বলে ফেললাম! তা ঐ তিন বুড়ো ছিলেন সেক্রেটেরিয়েটে আমার দাদু’র কলিগ। দাদু’র প্রভিডেন্ট ফান্ড না কি কি সব নিয়ে যেনো উনারা বড় ফুপুর সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন। ফুপু আমায় বললেন, ‘দৌড়ে গিয়ে বিশ টাকার চানাচুর নিয়ে আয়।’ এনে দিতেই সেটার সাথে কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, আচারের তেল, লেবু কচলে এক অপরূপ মুড়িমাখা বানিয়ে বাটিতে বাটিতে ঐ দাদুদের দিয়ে আসতে বললেন। নিজে একটু পর হাতমুখ ধুয়ে একটু পরিপাটি হয়ে চা নিয়ে এলেন। ফুপুর কোলের মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়ে আমি সবার সব কথা গিলছিলাম। দাদুর প্রভিডেন্ট ফান্ড ‘ম্যাচিউরড হয়েছে। রিটায়ারম্যান্ট বেনিফিট ও প্রভিড্যান্ট ফান্ড মিলিয়ে লাখ সাতেক টাকা পাওয়া যাবে। তাই তাঁর সন্তানদের এখন অফিস যেয়ে কাজকর্ম শুরু করা উচিত, এরকম সব কথা। সংসারের যাতাকলে পরে অকাল প্রৌঢ়ত্বে পৌছে যাওয়া আমার ফুপু চুপ করে কথাগুলো শুনে অস্ফুটে শুধু বলতে পেরেছিলেন, ধন্যবাদ চাচা। কেন যেন তিন বুড়ো হঠাৎ খুব আবেগ আক্রান্ত হয়ে গেলেন। ফুপুর মাথায় হাত দিয়ে নীল শার্ট পরা লোকটা যাওয়ার আগে বলে গেলেন, তোমার বাবা তোমার কথা খুব বলতেন মা’ । তার বড় বেদনার জায়গা ছিলে তুমি। গৌরবেরও।
এর ফাঁকেই আমি দেখে ফেলেছি কাকা মেঠো ইঁদুরের মতো চুপিসারে একফাঁকে লুকিয়ে ঢুকেছেন বাসায়। ঢুকে মুখ চোখে করুণভাব ফুটিয়ে ইশারায় কাকীকে পেট দেখিয়ে বলেছেন খুব ক্ষুধা লেগেছে। দাদুরা চলে গেলেন। বড় ফুপু, মেঝ ফুপু, কাকি আমরা সবাই রান্নাঘরে। উনারা হাত চালিয়ে কাজ করছেন, আর আমি রান্নাঘরের সাথে লাগোয়া একচিলতে বারন্দায় দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির ফর্সা ফর্সা বাচ্চাগুলাকে দেখছিলাম। ঐ বাসার আঙ্কেল কি যেন একটা অদ্ভুত কাজ করেন! প্রায়ই তার খোঁজে হৈ হৈ করে খুব রেগে যাওয়া কিছু মানুষ আসে। জোচ্চর, দালাল, ঠগ, দেখে নিব এসব খারাপ খারাপ কথা বলে খুব শাসিয়ে যায় লোকগুলো। তখন তিন তিনটে শিশু বাচ্চা নিয়ে ভয়ে আমাদের বাসা লাগোয়া তাঁদেরও রান্নাঘরের বারান্দায় এসে থরথর করে কাঁপতে থাকেন আন্টি। অপরূপা এ মেয়েটিকে মাঝবয়সী আঙ্কেল বছর কয়েক আগেই বিয়ে করে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিলেন। এ ক’বছরেই তাদের তিন তিনটা শিশু! প্রায় প্রায়ই ঐ বাড়ি থেকে আঙ্কেলের গর্জন আর কাউকে মারের শব্দ শোনা যায়। বাচ্চাগুলোর কান্না, আন্টির আর্তনাদ,সব মিলিয়ে মনে হয় সেগুন বাগিচার পুরনো এ আবাসিক ফ্ল্যাটের এ জঞ্জালে যেনো তখন দোজখ নেমে আসে। কানে হাত দিয়ে আমিও কাঁপতে থাকি এপাশে। তার কিছুক্ষণ পরই আবার বিরিয়ানির সুগন্ধ ভেসে আসে ওবাড়ি থেকে। থমথমে মুখে আঙ্কেল নিচের বিরিয়ানির দোকান থেকে কিনে আনা খাবার একে একে স্ত্রী ও শিশুদের মুখে নিজের হাতে তুলে দিতে থাকেন। আমি দেয়ালের সাথে মিশে গিয়ে লুকিয়ে জানলার গ্রিলের ফাঁকা দিয়ে দেখি চোখের জলের সাথে হাসিতে মেখেজুখে লোকমা মুখে নিচ্ছে পরিবারটার ছোট বড় সবাই। তখন কেন যেন ঐবাসাটাকে আমার আর দোজখ বলে মনে হয়না। রূপকথার বইয়ে পড়া “ স্বার্থপর দৈত্য ও ফলের বাগান” গল্পটার কথা মনে পরে যায় আমার।
ফুপুদের রান্না শেষ। হঠাৎ বড় ফুপুর একটা কথায় আমার কান ও চোখ এখন ঐ বাড়ি থেকে এখানে ফিরে আসলো। বড় ফুপু স্বগতোক্তির মতন করে বলছেন, ‘মাঝে মাঝে আমি নিজেকে বিয়ের বাজারের নিক্তিতে তুলে নিজেই নাম্বার দেই বুঝলি। রূপ নেই, রঙ নেই, বাবা-মা নেই, ভাইদের জোর নেই, কিছু নেই। তাই দুঃখও নেই। এই যে আমার বাবার অতি কষ্টে করা এ ঘরটি, ভাইরা তাদের বৌয়েরা, বোন, তুতুল সোনা এ কি কম সুখ ? বুঝেছ, বলে কাকির মুখটা বড় স্নেহে দু’হাতের তালুতে ধরে কাছে টেনে এনে মাথার সিঁথিতে একটা চুমু খান। তারপর একটা প্লেটে ভাত তরকারি বেড়ে স্নিগ্ধ হেসে তার হাতে দিয়ে বলেন, যাও, পতিদেবকে খাইয়ে এসো।’ তাকিয়ে দেখি মেঝ ফুপু ফ্লোরে একটা টুলে বসে একমনে দু’হাতের কড় গুনে কি যেন হিসাব করছেন। বড় ফুপু বলেন, কি রে! কি হিসাব করিস অতো? ছলছল মুখটা তুলে মেঝ ফুপু মিষ্টি করে উত্তর দেন, আমিও আমার জীবনটা হিসেবের দাড়িপাল্লায় তুলি রে! দেখ, তিন পেয়েছি! তুই, তুতুল আর আমি। বড় ফুপু হাঁটু গেঁড়ে বসে পরে মেঝ ফুপুকে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর বললেন তাইতো! তুই তো ত্রিজগতের সবচেয়ে ধনী রাজকণ্যা। তুই আমাদের সাত রাজার ধন মানিক।
আমি তুতুল এ অপরূপ দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকি। আমাদের অতি সাধারণ রান্নাঘরের দৃশ্যপট তখন একটা মঞ্চ আর সেখানে রচিত হচ্ছে বিশ্বকর্মার চিরপুরাতন সৌন্দর্যসৃষ্টির যাদু। আর সেই অপার্থিব আনন্দেই কিনা জানিনা জঙধরা পুরনো গ্রিল বেয়ে তখন হু হু করে দখিনা বাতাস এসে আমাদের ঘর দুয়ার, মেঝে, মলিন আসবাব ছুঁয়ে মধ্যবিত্ত এ গৃহকোণের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দিতে থাকে মায়া নামের গুঁড়ো গুঁড়ো সোনার রেণু।
তাহসীনা সাইফুল্লাহঃ সপরিবারে বসবাস করছেন সিঙ্গাপুরে। লেখালেখি তার প্রিয় শখ।