ফারহানা তেহসীন খান
মেহেরজানকে আমি ভীষণ ভালবাসি।
মেহেরজান আমার নিচতলার বাসার ভাড়াটে। ভীষণ মায়াবতী।
যেদিন দেখা হয়, সারাদিন বেঘোর কাটে।
যেদিন দেখা হয় না, বেসামাল হৃদয় আছাড় খায় হেথায় হোথায়।
এমবিবিএস পরীক্ষা দুরূহতর ঠেকে। তারপরও মেহেরজান কে পাবার আশায় মন প্রান লাগিয়ে দেই। ইচ্ছে হয় বলি, তোমার সকল আঁধার আমাকে দাও, আমার রাতের তারার সব আলো তোমাকে দিলাম। নিচতলার উঠানে গোলাপ গাছ গুলো শীতে বেদম দোলে। সেই সাথে দোলে আমার আলুথালু মন। মেহেরজান মাঝে মাঝে গোলাপ গাছে পানি দিতে আসে। আমি সেই বিকেলের জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকি।
কোনসময় উঠানে দেখা হলে কথা হয় । সে শুধু পুতুলের মত মাথা নাড়ে। হু হাঁ জবাব দেয়। ইচ্ছে হয় বলি, মাত্র এলে, আরেকটু থাকো, শ্বাস নেই প্রান ভরে।
বাবা হয়ত ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন—
বাবা বোধহয় ডাকছেন—
বাবা হয়ত এসে পড়েছেন—
বাবার চা খাবার সময় হয়েছে—
এই বাহানায় সে আকুল প্রেমিককে অকুল পাথারে দাঁড় করিয়ে পালিয়ে যা্য।
একদিন বললাম,
– তুমি এত কম কথা বল কেন ?
– আমার সাথে আপনি বেশিক্ষণ কথা চালিয়ে যেতে পারবেন না, তাই বলি না।
– তাই বুঝি? বল দেখি।
– আচ্ছা বলেনতো কোন বাচ্চার কোন বাবা মা থাকে না।
– এটা আবার কি? মাথায় কিছু আসছেনাতো।
– চৌবাচ্চার।
মেহেরজান হাসছে। ওর হাসিটা সারা জীবনের জন্য আমার মনে গেঁথে গেল।
তার বাবাকে মানে খো্রশেদ সাহেবকে সে দেখি যমের মত ভয় পায়। আমিও এক আধটু পাইনা- তা নয়। দৃঢ় ব্যক্তিত্বের লোকটাকে শুধু ভয় নয়, শ্রদ্ধাও হয়। খোরশেদ চাচার সাথে কালে ভদ্রে দেখা হয়।
একবার মা জানতে চেয়েছিলেন, আপনার সামর্থ্য আছে, নিজেই কেন বাড়ি বানালেন না? চিরস্থায়ী একটা ঠিকানা হত।
জবাবে বলেছেন, মাটির উপর ঠিকানা চিরস্থায়ী হয় নাকি। আসল বাড়ি মাটির নিচে। সাড়ে তিন হাত। ওইটুকুই যথেষ্ট। ওখানে ভাল আলো বাতাস পেলেই হবে। গভীর তত্ত্বকথা। গোলাপ আর গোলাপবালাকে নিয়ে আমার রাত আর দিন কাটে। যেদিন কথা হয় জীবনটাকে মসলিন রুমালের মত মনে হয়।
একদিন ছাদে হাঁটছি, হটাত দেখি গোলাপবালা নিচের উঠানে । মেয়ে যতই গোলাপের দিকে ঝুঁকছে, বান্দা ততই কার্নিশের দিকে ঝুঁকছে। তাকে দেখছি আর দেখছি। জীবনীশক্তি সঞ্চয় করছি। নেশার মতো , মারিজুয়ানা, এলএসডির মত সে আমার স্বপ্নে, রক্তে মিশে থাকে। দিনরাত। অবিরত।
-কি দেখ?
গোলাপ বনে দৈত্য। আমার বড় ভাবির একমাত্র ভাই। দোতলায় আমি, মা, বড় ভাই-ভাবী এই নিয়ে আমার পরিবার। বড় ভাই রাজধানীতে চাকুরী করেন। ভাবীসহ মাঝে মাঝে চট্টগ্রামে আসেন। তখন ভাবীর ভাই জাফরের আনাগোনা হয় এই বাসায়। বললাম,
– গোলাপ দেখি। বাগান ভর্তি গোলাপ।
– গোলাপ নাকি গোলাপবালা? চারদিক যা গরম পড়েছে, তোমার তো এসি কামরায় গা এলানোর কথা। ছাদে কি?
– আমার ছাদে আমি ইচ্ছা করলেই আসতে পারি, তাই না জাফর ভাই?
– মেয়েটা সুন্দর আছে। আসতে যেতে দেখেছি। ভাল লেগেছে। জানতো, তোমার ভাবী আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আপাই বলেছে আমাকে এই মেয়েটার কথা। ফিগারটাও দারুণ, কি বল?
– তুই একটা লুচ্চা।
– কি বিড়বিড় কর? ঝেড়ে কাশ মিয়া।
– ঝেড়ে থুথু দেবো তোরে।
– আরে মিয়া জোরে কও।
– আপনার ধারণা- আপনি বলবেন আর মেয়েটাও সম্মতি দিয়ে দেবে?
– দেবে না মানে, ওর বাপ দেবে। পার্ক করা গাড়ীটা দেখেছ? মিডল ক্লাস মেয়েরা কী চায় আমার জানা আছে।
– তুই একটা শুয়োর।
– কী বললে তালতো, শুনতে পাই নাই।
– আপনার ধারনা ভুল। এরকম কিছুই হবে না।
– শোন, আমি হচ্ছি জাইল্লা। ক্লাস ফাইভ থেকেই জাল ছোঁড়ার অভ্যাস। কারেন্ট জালে আটকাবো এই মেয়েটারে। বুঝলা তালতো ?
মেহেরজান বৃক্ষপ্রেমী। নীচের তলার ঊঠানের একপাশে গোলাপসহ কয়েকরকমের গাছগাছালী আর পাতাবাহার। গরমে দোলে, শীতেও দোলে। এক বিকেলে খোরশেদ চাচার সাথে দেখা।
– কেমন আছো বল। ডাক্তারি পাস করে ফেলো তাড়াতাড়ি। তোমাকে বিনা ফি”তে ভিজিট দেবো, কেমন?
– নিশ্চয়ই, আপনি কেমন আছেন চাচা?
– বেশি ভালো না। তুলসী পাতা নিতে এলাম। মেহেরজান লাগিয়েছে। খুব উপকারী, জানো। পানিতে সিদ্ধ করে অল্প মধু মিশিয়ে খাই। ভাবছি মা মরা মেয়েটাকে কোন ডাক্তারের সাথে বিয়ে দেব। এত অসুখ বিসুখ লেগে থাকে আমার, জামাই বাবাজি ফ্রিতে চিকিৎসা করবে, কি বল।
মেহেরজান, গোলাপ আর আমার প্রেম, এই নিয়ে জীবনের চন্দন মাখা বিকেলগুলো চলে যেতে পারতো বাদামের খোসা উড়িয়ে উড়িয়ে। হল না তো।
মেডিকেলে একটা সংবাদ ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। নতুন এক ভাইরাস সংক্রমণে চীনে কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছে যেটা খুবই ভীতিকর বলে চিকিৎসকেরা উল্লেখ করছেন। এই ভাইরাসটি প্যাথোজেন পরিবারের এবং এর নাম করোনা ভাইরাস। রেস্পিরেটরি লক্ষণ ছাড়াও জ্বর , কাশি, শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যাই মূলত প্রধান লক্ষণ। এবং এটি ফুসফুস আক্রমণ করে।
উহান শহরে দিনদিন ভাইরাসটির বিস্তার বাড়ছে। শহরটি থেকে ইতিমধ্যে বহির্গামী বাস, ট্রেন এবং বিমান চলাচল নিষিদ্ধ। উহান কে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। আপাতত মেডিকেল জগতে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা নেই। তাই রোগ প্রতিরোধের উপর জোর দেয়া হচ্ছে।
রাতে ঘুমাতে গেলে জানালা দিয়ে চোখ চলে যায় বহুদূর। জানিনা কোন কাল মেঘ ধেয়ে আসছে পুরা বিশ্বের দিকে। ভাইরাসটি কি বাংলাদেশের আকাশে বাতাসেও ছড়িয়ে পড়বে ? মেহেরজানের শ্বাসের সাথে ঢুকে যাবে নাতো। ইদানিং মন খারাপ করে ঘুমাতে যাই। বহির্বিশ্বে নতুন রহস্যময় ভাইরাস, আর আমার ভিতরেও এক রহস্যময়ী ভাইরাস।
যেদিন তাকে দেখি, জীবনবোধ পাল্টে যায়। সকালটা অমলেট আর বিকালটা ঘিয়ে ভাজা হয়ে যায়।
কয়েক মাসের মধ্যেই চীনের অন্য শহরে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়ার সাথে সাথে থাইল্যান্ড, জাপান, কোরিয়াতেও সংক্রমণ নিশ্চিত হল। ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট অর্থাৎ আইইডিসিআর থেকে সকলকে সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলা হচ্ছে। দেশে এখনো আক্রান্তের খবর পাওয়া না গেলেও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা শুরু হয়েছে।
করোনা সংক্রমণে মৃত্যুহার বাড়তে থাকায় একসময় দেশে মেডিকেলে যারা শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, জ্বর, সর্দি, গলা ব্যথার সমস্যা নিয়ে আসছে তাদের ভালভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হল। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ব্রাজিল, ভারত, পাকিস্তানের সংক্রমণ ও মৃত্যুহার আতংকজনক হয়ে দাঁড়াল।
জীবনের রং ধূসর আর চন্দন বিকেলগুলো পানসে । যখন শীত বিদায় নিয়েছে, হটাত করোনায় আক্রান্ত অসংখ্য ব্যক্তি শনাক্ত আর মৃত্যুতে দেশবাসী থমকে গেল। মেডিকেলে, শহরে, আকাশে, বাতাসে, কফির টেবিলে, সংসদে, রেস্তোরাঁর কোলাহলে একটাই গুঞ্জন- কোভিড- ১৯। আইইডিসিআর হটলাইন খুলেছে। উপসর্গ দেখা দিলেই যোগাযোগের আহ্বান।
আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে দুটো শব্দ, কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন । এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে অনেক দেশ কোয়ারেন্টিনের আশ্রয় নিচ্ছে, বিশেষ করে পুরো ইতালিকে অবরুদ্ধ করার ঘোষণা এসেছে। মেডিকেল থেকে ফিরে বিকেলে উঠানে কখনো কখনো মেহেরজানের সাথে দেখা।
– কেমন আছ মেহেরজান ?
– বাবার ডায়াবেটিস আছে জানেনতো। নয়নতারা ফুল নিতে এসেছি । পানিতে ভিজিয়ে রেখে রোজ বাবাকে খাওয়াই । ডায়াবেটিস কমে নাকি এতে। খেতে সামান্য তিতা লাগে এই যা।
– ভালইতো, চালিয়ে যাও।
– দিনকাল ভাল না, সাবধানে থাকবেন, কোভিড বাড়ছে সবখা্নে।
– ঠিক আছে, তোমরাও প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হবে না। চাচাকে বলবে যা লাগবে বাজার সওদা, ওষুধপত্র আমাকে বলতে।
– আপনাকেই বলব বাজার সওদা, ওষুধপত্র সব। কিন্ত বাবা কি কোন কথা শুনেন? সুযোগ পেলেই গলির মুখে চলে যান।
– তুমি আটকে রাখবে।
– ঠিক আছে জাঁহাপনা।
– গুড। এইতো কি সুন্দর কথা বলে যাচ্ছ।
– আচ্ছা বলেন দেখি, কোন চুড়ি মেয়েরা পড়ে না?
– জানিনা।
– খিচুড়ি। সেই যে বলেছিলাম, আমার সাথে বেশিক্ষণ কথা চালাতে পারবেন না।
– পাগলি।
বলে আমি গভীর চোখে মেহেরজানকে দেখে নেই । মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কি অতল মায়া সেই চোখে। আমি মনে মনে বললাম, তোমার সব আঁধার আমাকে দাও আর আমার রাতের সব তারার আলো তোমাকে দিলাম। নিয়ে নাও মেয়ে।
বিকেলতো নয় যেন চন্দন বাতাসের সুগন্ধি কৌটো। যেদিন তাকে দেখি, নতুন করে জীবনীশক্তি সঞ্চয় হয়। ইচ্ছে হয় কানে কানে বলি, মেয়ে, তোমার জন্য আদিনাথের পাহাড়ে উঠতে পারি এক লাফেতে।
দিন যায়। চতুর্দিক করোনা কথন। বিষবাস্পে ভরে গেছে পৃথিবী। চরম মহামারী। আমরা বাঁচবো কি? যখন তখন কেউ আর ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে না। মেহেরজান কে দেখাও দুষ্কর হয়ে উঠল।
পাগলের মত বারান্দা, ছাদ, সিঁড়ি, ব্যালকনি, সবখানে দৌড়াই। কোথাও দেখিনা। পরীক্ষার বছর শুরু হয়। ঘুম হয় না। দুঃস্বপ্ন ছড়ায়। জীবনঘাতি কোভিডে বিপর্যস্ত জনজীবন।
এই কঠিন সময়ে কানাডা থেকে মেহেরজানের একমাত্র বড় ভাই এলেন। শাহেদ ভাইকে দেখে ওরা যেন নতুন জীবনীশক্তি পেয়েছে । মেহেরজানের দেখা পাওয়া যায়না। মন খারাপের দিনগুলো উলের বলের মত ছড়াতে থাকে, লম্বা হতে থাকে।
একসময় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল। কোভিডের উপসর্গ, বিস্তার, সংক্রমণ, মৃত্যুহার বেড়েই চলেছে। সরকারী ছুটি বাড়ল। গণ পরিবহণ অবরুদ্ধ। এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যাওয়া নিষেধ। দেশ বিদেশের অনেক ফ্লাইট বন্ধ।
এরপর একদিন দেশজুড়ে লকডাউন। কঠিন সময়, কাটে না। পাহাড় সম, হাঁটে না। শাহেদ ভাইয়ের সাথে মাঝেমাঝে দেখা হয়, কথাও হয়।
বিজ্ঞানী আর চিকিৎসকদেরকে, শক্তিধর আর ক্ষমতাশালী দেশগুলোকে কোভিড ১৯ বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যাচ্ছে । আমরা সেই ব্যপারে কথা বলি। বহির্বিশ্বে ,শহরে শহরে, ঘরে ঘরে, কান্নার রোল উঠছে, কফিন তৈরি হছে অগণিত। আমরা সেই ব্যাপারে কথা বলি।
তারপর একদিন। শাহেদ ভাই বললেন তার দেশে আসার উদ্দেশের কথা। কাছের বন্ধু, কানাডা প্রবাসী বন্ধু ইমনকে তিনি মেহেরজানের জীবনসঙ্গী নির্বাচন করেছেন। শুভ কাজটা পরিস্থিতি ভাল হলেই সেরে ফেলতে চান।
কেউ কী এভাবে সামনে থেকে বুকে ছুরি মারে? আখের ছোবড়ার মত কেউ যেন ছুঁড়ে ফেলেছে আমার ভালবাসা। জীবনের সুমিষ্ট পঙক্তিগুলো এখন অচল পদাবলী।
মেহেরজানের দেখা নাই। ‘হৃদয় না জুড়াতে , হারাইয়া ফেলি চকিতে”
অস্থির দিন আর নিথর রাত। কাটে না, হাঁটে না।
মহামারীতে বিপর্যস্ত জীবন, স্বজনের দাফনে স্বজন সামিল হয় না, এমন যখন দুনিয়া, এক রাতে অসময়ে আমার দরজায় দারুণ করাঘাত। দরজা খুলেই অবাক। মেহেরজান। এত রাতে?
– বাসায় চলেন মারুফ ভাই, দুদিন আগে থেকে বাবার ঠাণ্ডা লেগেছিল, কাশি ছিল। আজ জ্বর এসেছে, খুব অস্থির করছেন। জলদি বাসায় চলেন।
আমি আর মেহেরজান মুখোমুখি। এই লহমায় যদি পার হয়ে যেত গোটা জীবন। সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে নিবিড় পযর্বেক্ষনে রাখা হল চাচাকে। আমার আন্তরিকতা আর একনিষ্ঠতা দেখে শাহেদ ভাই কৃতজ্ঞতা দেখাতে ভুললেন না।
ঔষধ চালু করার পর দুই দিনেও বিশেষ রকমফের না হওয়াতে হাসপাতালে নেয়ার সিদ্ধান্ত হল। চাচার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে, শাহেদ ভাই যখন এ্যাম্বুলেন্সের জন্য ঘর বাহির করছেন, আমি চাচার পাশে দাঁড়িয়ে আছি।
– চাচা, জোরে শ্বাস নেন। সাহস হারাবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
তারপর— সেই ক্ষণ ।
তিনি আমার হাতটা ধরলেন। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে নিতে বললেন,
– তোমার চেয়ে বেশি আর কেউ আমার মেয়েটাকে ভালবাসবে না। ওকে তুমি দেখো।
– আপনি কথা বলবেন না। বুক ভরে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করেন। আমি আছি চাচা।
আমার সাথে চাচার এটাই ছিল শেষ কথা। মেডিকেলের কাছাকাছি আসতেই উনার ভীষণরকম শ্বাসকষ্ট শুরু। বুঝতে পারছিলাম, কঠিন সময়ের দিকে এগোচ্ছি। মহামারীতে চাচা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
শুধু আমি নই। পুরা বিশ্ব থমকে গেছে। পরম শক্তিশালী দেশগুলোর মত অপারগতা আর অক্ষমতার লজ্জা নিয়ে ডুবে থাকি আকণ্ঠ।
এই মহামারিতে , সব দেশে, ব্যর্থতার শহরে, মফস্বলে, অলিতে গলিতে, পথে প্রান্তরে, প্রাসাদে, কুঠুরিতে কতই না ব্যক্ত অব্যক্ত গল্প আছে জীবনের। লাখো মানুষের।
হিসাব নাই। কতই না লাশ উঠেছে, কত চোখের পানি চোখেই শুকিয়েছে, কত রক্তের সম্পর্ক মুখ লুকিয়েছে, কত কবর লজ্জায় কবরে কেঁদেছে।
হিসাব নাই। লাশের পর লাশ। বাবার লাশ, চাচার লাশ, মায়ের লাশ, ভাইয়ের লাশ, সহপাঠীর লাশ, বন্ধুর লাশ—-
মৃত্যু একটা সংখ্যা মাত্র। মানুষের জন্য মানুষ কাঁদে। ব্যর্থতার গ্লানিতে অন্ধকার কাঁদে। কাঁদে শ্রাবণের আকাশ। ফুলেরা কাঁদে, কাঁদে পাতা, কাঁদে পাখি। বাইবেল কাঁদে, কাঁদে কুরআন। মহাভারত কাঁদে, কাঁদে ইতিহাস, কাঁদে বর্তমান।
তারপর একদিন অস্থির দিনলিপির এই নগরে, স্বল্প পরিসরে ইমনের সাথে মেহেরজানের শুভ পরিণয়।
মেহেরজান গোলাপ বাগানে আসে। ফুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। আমি দোতলার বারান্দা থেকে দেখি তার অনামিকায় জ্বলজ্বল করা আংটি।
জাফর ভাই একদিন বললেন, আমি তোমার চোখে যা দেখেছিলাম, সে জন্যই এখানে জাল বিছাই নাই। তুমি কেন আটকাতে পারলে না? বেরসিক জাইল্লা ।
অভিমান হয়, ঘরের ভেতরে না হয় কোন সাক্ষী ছিল না, তাই বলে মেহেরজান কি ভাইকে কিছুই বলতে পারতো না। কয়েকটা বছর অপেক্ষা করা এতই দুরূহ ছিল তাদের জন্য?
তারপর যেদিন তুমি চলে যাচ্ছিলে —- আরেকবার। শেষবার। মুখোমুখি।
মেহেরজান,
তুমি আমার চোখের দিকেই তাকিয়েছিলে। সর্বস্বান্তের মত আমি দাঁড়িয়ে। আমার চোখে জল।
বেশরমের মত একফোঁটা গাল বেয়ে টপকালো। সেটাও তুমি চেয়ে চেয়ে দেখলে।
দাবী রেখে বলতে পারি, এই সর্বস্বান্ত পথিককে, যে তোমার প্রেমে পথ হারিয়েছে, তাকে কোনদিন তুমি ভুলবে না।
বাজি রেখে বলতে পারি, অলস দুপুরে, অঝোর বৃষ্টির রাতে বা শীতের কনকন হাওয়ায় আমাকেই পাবে তুমি।
চলে যাও মেয়ে। আর একটু যদি দাঁড়িয়ে যাও, বাজি রেখে বলতে পারি, আমাকে ছেড়ে এক পাও যেতে পারবে না তুমি। বাজি। অনেক অনেক মাস পর—-
শহর পুরানো রূপে ফিরতে শুরু করে। মেহেরজানের চাকচিক্যময় আলোর শহরের কাছে আমার জীবন যেন পিদিম জ্বলা সাঁঝ। মেহেরজানের জন্য নায়াগ্রা ফলস আবিরাম ঝরে চলে।
আর আমার জন্য?
কাঁদে শ্রাবণের আকাশ
কাঁদে জোছনা
কাঁদে বালুচর
কাঁদে কাশবন
কাঁদে মেঘনা ।।

ফারহানা তেহসীন খান, সহধর্মিণী ক্যাপ্টেন আতিক খান ( বিএমএ, ২৭ ব্যাচ)