গাজী আবু তাহের
একজন নৈমিত্তিক লেখক
আমার জাহাজী জীবনে চিত্ত বিনোদনের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে বাঙালি নাবিকদের নিয়ে। তরঙে তরঙে দোল খেতে খেতে যখন আমার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, তখন ও বেঁচে থাকার একটা সূত্র খুঁজে পেতাম এই অসাধারণ নাবিকদের কর্মকান্ডে। মজার মজার খবর কিংবা তাদের কথোপকথন সমৃদ্ধ করতো আমার আনন্দের ভান্ডার।
বন্দরে ভিড়বার দু’-একদিন আগে থাকতেই সেকেন্ড অফিসারের গুরুত্ব বেশ বেড়ে যেত। পেট ব্যথা, শরীর ব্যথা, গা ম্যাজ ম্যাজ করা থেকে শুরু করে ক্ষুধা মন্দা এ ধরণের রোগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠত। রুগির বর্ণনার উপর নির্ভর করে একটা তালিকা ক্যাপ্টেনের কাছে জমা পড়তো, কারা কারা ডাক্তারের কাছে যাবে। বাঙালি নাবিক হবার কারণে বন্দরে ভিড়বার পরে দোভাষী একজনের দায়িত্বে পড়তো নাবিকদের অসুবিধাগুলোকে ডাক্তার বাবুকে বুঝিয়ে বলবার জন্যে। মজার বিষয় হলো, দোভাষীকেই অনেক সময়ে এমন নাজুক পরিস্থিতিতে পড়তে হ’ত যে তার নিজের সম্পৃক্ততাও বিব্রতকর অবস্থার অবতারণা করত। আজ আর সেই দিন নেই! অনেক শিক্ষিত নাবিক যুক্ত হয়েছেন আমাদের নৌবহরে! বলাবাহুল্য, এখন শুধু ইংরেজীতে নয়, অনেকে অন্যান্য দেশের ভাষায়ও দিব্যি কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারেন!
মূল গল্পে আসি। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমি তখন বি এস সি এর এক জাহাজে নামে মাত্র ফোর্থ অফিসার হিসেবে কর্মরত।
অনেক পথ পাড়ি দিয়ে আর সমুদ্রপীড়ন সহ্য করে উত্তর সাগর হয়ে জার্মানীর হ্যামবুর্গ বন্দরের দিকে এগিয়ে চলেছি। উত্তর জার্মানীর প্রধান বন্দর এই হ্যামবুর্গ যা “এলবে” নদী দিয়ে উত্তর সাগরের সাথে যুক্ত হয়েছে। চারপাশ জুড়ে অনেক শাখা-প্রশাখা নদী। রাডারে সেগুলোর অবস্থান টের পাচ্ছি। “এলবে” নদী বেয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এগিয়ে চলছে জাহাজ। পাইলট উঠেই এফ এম রেডিও ধরিয়ে দিলেন। ভোর বেলায় বেশ লাগছিল ব্যন্ডের কড়া বিট গুলো! নদী বেয়ে বেশ কিছুক্ষণ নিচে নামতেই হঠাৎ করে তিনি মিউজিক বন্ধ করে দিলেন। খুব কৌতুহলী হলাম। শান্ত নদী আর ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া কোনো আওয়াজ নেই। অ্যাডমিরালটি চার্টে চোখ বুলিয়ে অবস্থান দেখলাম “উইলকম হফট্”। আর তারপর ঘটলো আমার শুরু হওয়া নাবিক জীবনের একটা বড় বিস্ময়। যা ছিল অতি আনন্দের, লেখনীতে প্রকাশ করা কঠিন!

এ স্থানকে বলা হয় জাহাজ অভিবাদন স্টেশন, স্বাগতম পয়েন্ট। সকাল আটটা বেজে দুই মিনিট পাইলট হুকুম দিলেন “ডেড স্লো এহেড”! আমি ইঞ্জিনের গতি কমিয়ে “ডেড স্লো” বলে “বেল বুকে” সময় লিখে মাথা উঁচু করতেই দেখি হ্যামবুর্গের লাল পতাকা নামিয়ে বাদ্যবাজিয়ে “বোন ভয়েজ” পতাকা উত্তলন করা হল। আমরাও হুইসেল বাজিয়ে অভিবাদন গ্রহণ করলাম! এই সেই অভিবাদন স্থান যেখানে কেবল একই তালে পতাকা উত্তোলন কিংবা নামানোই হয়নি বরঞ্চ অত্যন্ত সম্মানের সাথে বাজানো হয়েছিল আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। কানে বাজছে “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি”। আর আমাদের স্নায়ু ও রক্তে প্রবাহিত হচ্ছে চরম আনন্দের মূর্ছনা। একটা দেশের জাহাজ ও জাহাজিদের স্বাগতম জানাবার কি অপূর্ব রীতি!!!
জাহাজে গতি ফিরলো।
এমনই এক সুখানুভূতি নিয়ে সকাল সকাল জাহাজ ভিড়লো। ক্যাপ্টেন সাহেবের কাছে নিয়ম মাফিক আগমনী রিপোর্ট দাখিল করার পর তিনি বললেন, রোগীদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। উনার অফিস রুমে অনেক লোকজনের সমাগম। হঠাৎ এজেন্টের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন :
“4th Officer will escort the patients.” আর আমাকে বললেন তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে থাকতে ।
এই আকস্মিকতায় কিছুটা অবাক হ’লাম। জার্মান দেশে এই আমার প্রথম পদার্পণ। জার্মানদের সম্পর্কে হিটলার আর জাহাজি কিছু মুখরোচক গল্প ছাড়া আমার কোন জ্ঞানই ছিলনা তখন। ইংরেজী যতটুকু জানি বা বলতে পারি, তাতে হয়তো ডাক্তারকে বোঝাতে পারবো, কিন্তু জার্মান ভাষা তো আমার অজানা। অনেকটা নার্ভাস হয়েই উনার কেবিন থেকে প্রস্থান করলাম।
এক ডেক নামতেই দেখি সেকেন্ড অফিসার তার কেবিনের দরজার সামনে দাড়ানো। ষ্টেশন শেষে প্রাতঃরাশ সেরে কেবল ফিরেছেন। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। বললেন: “নাবিকদের নিয়ে যাও। আধা বেলা ঘুরে আস।”
: স্যার, আমি তো জার্মান বলতে পারি না। কিভাবে ডাক্তারকে বোঝাবো?
হাসি দিয়ে বললেন – “Don’t worry. Doctor understands English!”
হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম! কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি যে, সামনে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে ! আমি তৈরী হয়ে “গ্যাং ওয়ে”তে (নাবিকদের ভাষায় গাং বারি) নামতেই দেখি সুন্দর পোশাকে সবাই প্রস্তুত। আশ্চর্যের বিষয় যে, যারা ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন তাদের কাউকেই অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে না …. অথবা ইতিমধ্যে বাইরে যাবার সংবাদেই সুস্থ হয়ে উঠেছেন!
আমার হঠাৎ মনে হল, একবার আমি জিজ্ঞেস করি না কেন ওনাদের আসলে কার কি হয়েছে?
সবার সামনে সেকেন্ড কুক, হাসি মুখে সালাম জানালেন ।
: আপনার কি হয়েছে, সেকেন্ড কুক?
– স্যার, আমার ডান পায়ের মাঝখানে চেরে, কি যেন হেঙ্গে, বিদ্যুতের ঝিলিক খায়। খারাইয়া কাম করতে কষ্ট হয়!
প্রথমে শুনতে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। সামনাসামনি না হাসলেও ভিতর ভিতরে হেসে নিলাম কিন্তু আমার হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি! জার্মান ভাষার ভয় কাটতে না কাটতেই মনে হল বরিশালের সেকেন্ড কুক তার মাতৃভাষায় যা বোঝালো, আমি নিজেও কখনো এমন অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত হইনি। মানুষের শরীরে যে এ রকম অবস্থাও হয়, তা কস্মিনকালেও ভাবিনি। আর ওনার ঐ বিবৃতিকে ইংরেজীতে অনুবাদ করার পর ডাক্তারকে কি বোঝাবো তা নিয়ে আবার চিন্তায় পড়লাম।
এক নম্বর লস্কর, বয়স্ক ভদ্রলোক। তিনিও বেশ কেতাদুরস্ত হয়ে এসেছেন। জিজ্ঞেস করতেই হাসি বিনিময় করে বাম হাতের তালুতে তর্জনী দিয়ে বৃত্ত বানাতে বানাতে বললেন
– স্যার আঁর টিকাত ফুলি গ্যাসে। কাইত্ হইতাম হারি নঅ ।
শুনে তো আমার আক্কেলগুড়ুম! সেকেন্ড কুকের অবস্থায় ইতিমধ্যে আমার মস্তিষ্কের ভিতর বিদ্যুৎ খেলে গেছে। আসলে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না উনার হয়েছে টা কি? উনাকে আবারও জিজ্ঞেস করলাম
: আপনার কি হয়েছে?
এবার উনি নিজেই হাসতে লাগলেন । আমি বেশ বিব্রত বোধ করতে থাকি।
– “স্যার, বইলছি তো আর টিকাত সমস্যা, ফুলি গ্যাছে ” ….
এবং অভ্যাসবশঃত তিনি হাতের তালুর উপর তর্জনী দিয়ে বৃত্ত আঁকতে থাকেন।
: দেখি আপনার হাত। কই আপনার হাতে তো কিছুই হয় নাই। ফুললো কোথায়?
এবার দন্ত বিকশিত হাসি দিয়ে বললেন
– “স্যার হিয়ানো না হিসে দি।”
জগতে কত কঠিন কাজই না করেছি, তবে এই কাজের ডিগ্রি খুব কঠিন মনে হতে লাগলো।
পরবর্তী জনকে জিজ্ঞেস করার আগে মনে হল সেকেন্ড অফিসারকে গিয়ে একটু জিজ্ঞেস করি!
-” Sir, Second cook is saying he has saw- cutting pain at the middle of his right leg, something ‘Hengey’ and he feels lightning. He has trouble cooking in standing position.
– Lascar 1, his injection swelled up. He cannot lay on his side.”
আমি উনার চেহারার ভিতর বড় ধরনের একটা হাসি দেখতে পেলাম।
হাসতে হাসতে বললেন
“He has a boil on his buttock.”!!
বহুদিন একাকী ভেবেছি কিন্তু আজও বুঝতে পারিনি টিকার সাথে হাতের তালু আর তর্জনীর কি পারস্পরিক সম্পর্ক???
__________________________________________________________________________________________________________

ক্যাপ্টেন গাজী আবু তাহের (১৭)ঃ একজন নৈমিত্তিক লেখক। চারপাশে যা ঘটে তা থেকেই জীবনের আনন্দ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
One Response
Excellent recap of the Golden Cadet days!!!!!